Header Ads

হরপ্পা সভ্যতা: সিন্ধু উপত্যকার প্রাচীন নগর সভ্যতার গৌরব । The Harappan Civilization

হরপ্পা সভ্যতা: সিন্ধু উপত্যকার প্রাচীন নগর সভ্যতার গৌরব

ভূমিকা

হরপ্পা সভ্যতা (৩৩০০–১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বিশ্বের প্রাচীনতম নগর সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমে বিকশিত হয়। সিন্ধু নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও এর বিস্তার ছিল বর্তমান পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তানের অংশজুড়ে। এই সভ্যতা তার উন্নত নগর পরিকল্পনাবৈজ্ঞানিক জল ব্যবস্থাপনা, এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-এর জন্য স্বীকৃত। অথচ এর লিপি আজও অজানা, যা একে ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় অধ্যায়ে পরিণত করেছে।

The Harappan Civilization


১. আবিষ্কার ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব

প্রাথমিক খনন ও চিহ্নিতকরণ

১৯২১ সালে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক দয়ারাম সাহনি পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলে হরপ্পা শহর আবিষ্কার করেন। ১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মোহেঞ্জো-দারো খনন শুরু করেন। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক জন মার্শাল ১৯২৪ সালে এই সভ্যতাকে "সিন্ধু সভ্যতা" নামে চিহ্নিত করেন।

আধুনিক গবেষণার মাইলফলক
WhatsApp Join Now
Telegram Join Now

  • লোথাল (১৯৫৪): গুজরাটে আবিষ্কৃত এই বন্দরনগরী সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রমাণ দেয়।

  • ধোলাবীরা (১৯৯০): কচ্ছের রণে অবস্থিত এই শহরে জল সংরক্ষণের অনন্য ব্যবস্থা পাওয়া গেছে।

  • রাখিগড়ি (২০১৪): হরিয়ানায় খননে মিলেছে ৫০০০ বছরের পুরনো কঙ্কাল ও স্থাপত্য।

২. ভৌগোলিক বিস্তার ও প্রধান কেন্দ্র

সীমানা ও আয়তন

  • আয়তন: প্রায় ১২.৫ লক্ষ বর্গকিমি (মিশর ও মেসোপটেমিয়ার চেয়ে বড়)।

  • প্রধান নদী: সিন্ধু, ঘগ্গর-হাকরা (সরস্বতী), ও সাতলুজ।

প্রধান শহর ও বৈশিষ্ট্য

শহরঅবস্থানবিশেষত্ব
হরপ্পাপাকিস্তান, পাঞ্জাববিশাল শস্যাগার, শ্রমিক ব্যারাক
মোহেঞ্জো-দারোপাকিস্তান, সিন্ধুমহান স্নানাগার, উন্নত ড্রেনেজ সিস্টেম
ধোলাবীরাভারত, গুজরাটজলাধার ও বাঁধের নেটওয়ার্ক
লোথালভারত, গুজরাটপ্রাচীন বন্দর ও জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র

৩. নগর পরিকল্পনা: প্রাচীনতম ইঞ্জিনিয়ারিং মডেল

গ্রিড পদ্ধতির রাস্তা

  • রাস্তাগুলো উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম অক্ষে বিন্যস্ত, প্রায় সমকোণে ছেদ করা।

  • প্রতিটি ব্লকে বাড়িগুলো স্ট্যান্ডার্ডাইজড ইট (অনুপাত ১:২:৪) দিয়ে তৈরি।

জল ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা

  • পয়ঃনিষ্কাশন: প্রতিটি বাড়িতে স্নানাগার, যা ঢাকা ড্রেনের সাথে যুক্ত।

  • জল সরবরাহ: কূপ, জলাধার, এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা (ধোলাবীরায় ১৬টি জলাধার)।

  • মহান স্নানাগার: মোহেঞ্জো-দারোতে ১২ মিটার লম্বা, ৭ মিটার চওড়া ও ২.৪ মিটার গভীর পুকুর, সম্ভবত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য।

স্থাপত্যে সামাজিক সমতা

  • কোনও রাজপ্রাসাদ, মন্দির বা বিশাল সমাধির অস্তিত্ব নেই।

  • সাধারণ বাড়িগুলোতে ২-৩ তলা, অভ্যন্তরে উঠান ও কূপ।

৪. অর্থনৈতিক কাঠামো: কৃষি থেকে বৈশ্বিক বাণিজ্য

কৃষি ও শস্য উৎপাদন

  • ফসল: গম, যব, খেজুর, তিল, ও প্রাচীনতম তুলা চাষ (মেহেরগড়ে প্রমাণিত)।

  • সেচ পদ্ধতি: নদীর প্লাবনকে কাজে লাগানো এবং খাল খনন।

শিল্প ও কারুশিল্প

  • মৃৎশিল্প: লাল মাটির পাত্রে কালো রঙের জ্যামিতিক নকশা।

  • ধাতুবিদ্যা: তামা ও ব্রোঞ্জের সরঞ্জাম (কাস্তে, ছুরি), "নর্তকী" মূর্তি।

  • মুক্তা ও গহনা: কার্নেলিয়ান, স্টিয়াটাইট, ও সোনার গহনা।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য

  • রপ্তানি পণ্য: তুলা, হাতির দাঁত, সীলমোহর, ও গহনা।

  • বাণিজ্য অংশীদার: মেসোপটেমিয়া (সুমের), ওমান, ও বাহরাইন।

  • পরিবহন: সিন্ধু নদীতে নৌকা ও স্থলপথে বলদ-টানা গাড়ি।

    WhatsApp Join Now
    Telegram Join Now

৫. সমাজ ও সংস্কৃতি: বৈচিত্র্য ও সমন্বয়

সামাজিক কাঠামো

  • শ্রেণিবিভাগের স্পষ্ট প্রমাণ নেই। সম্ভবত বণিক, কারিগর, কৃষক, ও পুরোহিতদের সমন্বয়ে গঠিত।

  • নারী-পুরুষ সমতা: মাতৃদেবীর উপাসনা ও নারী মূর্তির প্রাচুর্য।

ধর্ম ও বিশ্বাস

  • পশুপতি সীল: যোগীর ভঙ্গিতে বসা দেবতা, চারপাশে বাঘ, হাতি ও গণ্ডার।

  • প্রকৃতি পূজা: পিপল গাছ, অগ্নি, ও জলধারার প্রতীকী ব্যবহার।

  • পরকাল বিশ্বাস: কবরে মৃতের সাথে খাদ্য ও গহনা রাখার প্রথা।

বিনোদন ও শিল্প

  • খেলনা: মাটির গাড়ি, পুতুল, ও পাশা খেলার নিদর্শন।

  • নৃত্য ও সংগীত: ব্রোঞ্জের "নর্তকী" মূর্তি ও বাঁশির আবিষ্কার।

৬. লিপি ও ভাষা: ইতিহাসের অমীমাংসিত ধাঁধা

  • লিপির বৈশিষ্ট্য: ডান থেকে বামে লেখা ৪০০-৬০০ চিহ্ন, প্রধানত সীলমোহরে উৎকীর্ণ।

  • অনুবাদ চেষ্টা: ASCII কোডিং ও AI ব্যবহার করা হলেও সফলতা আসেনি।

  • ভাষা তত্ত্ব: সম্ভবত প্রোটো-ড্রাভিডিয়ান বা ইলামো-দ্রাভিডিয়ান মিশ্রণ।

৭. পতনের কারণ: প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে সাংস্কৃতিক রূপান্তর

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

  • সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়া: টেকটোনিক পরিবর্তনে নদীপথ বিচ্ছিন্ন।

  • বন্যা ও মরুকরণ: হরপ্পা অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হ্রাস ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি।

মানবসৃষ্ট কারণ

  • বাণিজ্য পতন: মেসোপটেমিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া।

  • সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: গ্রামীণ জীবনে ফিরে যাওয়া ও নতুন সংস্কৃতির সংমিশ্রণ।

আর্য আগমন তত্ত্ব (বিতর্কিত)

  • ঋগ্বেদে "পুর" (দুর্গ) ধ্বংসের উল্লেখ থাকলেও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে হিংস্রতার প্রমাণ কম।

৮. ঐতিহ্য: আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ায় হরপ্পার প্রভাব

  • স্থাপত্য: ড্রেনেজ সিস্টেম ও নগর পরিকল্পনার মডেল।

  • ধর্ম: শিবের আদিরূপ, যোগ, ও গো-পূজার ধারণা।

  • শিল্প: টেরাকোটা মূর্তি ও হস্তশিল্পের ধারাবাহিকতা।

৯. অমীমাংসিত প্রশ্নাবলী

১. হরপ্পাবাসীদের রাজনৈতিক কাঠামো কী ছিল?
২. লিপির অর্থ ও ভাষাগত পরিচয় কী?
৩. কেন বিশাল স্মৃতিস্তম্ভ বা মন্দির নির্মিত হয়নি?
৪. হঠাৎ পতনের সঠিক কালপঞ্জি ও কারণ।

উপসংহার

হরপ্পা সভ্যতা কেবল একটি প্রাচীন সভ্যতা নয়—এটি মানব সৃজনশীলতার এক মহাযজ্ঞ। এর নগর পরিকল্পনা আজও ইঞ্জিনিয়ারদের অনুপ্রাণিত করে, আর রহস্যময় লিপি গবেষকদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। হরপ্পার উত্তরাধিকার শুধু জাদুঘরের প্রদর্শনীতে সীমিত নয়; এটি বেঁচে আছে দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও শিল্পে।


WhatsApp Join Now
Telegram Join Now

No comments

Powered by Blogger.