সিন্ধু সভ্যতা: একটি প্রাচীন নগর সভ্যতার রহস্য ও মহিমা । the Indus Valley Civilization
সিন্ধু সভ্যতা: একটি প্রাচীন নগর সভ্যতার রহস্য ও মহিমা
ভূমিকা
সিন্ধু সভ্যতা, বা হরপ্পা সভ্যতা, বিশ্বের প্রাচীনতম নগর সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে ১৩০০ অব্দ পর্যন্ত এই সভ্যতা দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিকশিত হয়। সিন্ধু নদী উপত্যকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও এর বিস্তার ছিল বর্তমান পাকিস্তান, ভারত (গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব) এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশ পর্যন্ত। মেসোপটেমিয়া ও প্রাচীন মিশরের সমকালীন এই সভ্যতা তার উন্নত নগর পরিকল্পনা, প্রযুক্তি, এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য স্বীকৃত। তবে এর লিপি এখনো অপরিচিত থাকায় অনেক রহস্য আজও অমীমাংসিত।
১. আবিষ্কার ও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান
প্রাথমিক আবিষ্কার
WhatsApp
Join Now
Telegram
Join Now
১৯শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ প্রকৌশলী ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা রেললাইন নির্মাণের সময় হরপ্পা (পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চল) এবং মোহেঞ্জো-দারো (সিন্ধু প্রদেশ) নামক স্থানে প্রাচীন ইট ও সীলমোহর খুঁজে পান। ১৯২১ সালে দয়ারাম সাহনি এবং ১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যথাক্রমে হরপ্পা ও মোহেঞ্জো-দারো খনন শুরু করেন।
জন মার্শালের অবদান
১৯২৪ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক জন মার্শাল এই সভ্যতাকে "সিন্ধু সভ্যতা" নামে চিহ্নিত করেন। তাঁর নেতৃত্বে মোহেঞ্জো-দারোতে উন্মোচিত হয় সুপরিকল্পিত নগর, স্নানাগার, এবং ড্রেনেজ সিস্টেম।
আধুনিক গবেষণা
১৯৬০-এর দশকে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক এস.আর. রাও লোথাল (গুজরাট) আবিষ্কার করেন, যা একটি বন্দর নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৯৯০-এর দশকে ধোলাবীরা (কচ্ছের রণ) এবং রাখিগড়ি (হরিয়ানা) খননে সভ্যতার পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় বিস্তার নিশ্চিত হয়।
২. ভৌগোলিক বিস্তার ও প্রধান কেন্দ্র
সিন্ধু সভ্যতার আয়তন প্রায় ১২.৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার, যা প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়ার সম্মিলিত এলাকার চেয়ে বড়। প্রধান নগর ও বৈশিষ্ট্য:
মোহেঞ্জো-দারো
"মৃতদের স্তূপ" নামে পরিচিত।
মহান স্নানাগার, কল্পদ্রুম সড়ক, এবং দুই স্তরের বাড়ি।
উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ও জল সরবরাহ ব্যবস্থা।
হরপ্পা
বিশাল শস্যাগার ও শ্রমিক barracks।
কুমোরের চাকা ও ধাতু শিল্পের নিদর্শন।
ধোলাবীরা
জটিল জল সংরক্ষণ ব্যবস্থা (বাঁধ, খাল, জলাধার)।
তিন ভাগে বিভক্ত নগর (দুর্গ, মধ্য নগর, নিম্ন নগর)।
লোথাল
নৌবন্দর ও ডকইয়ার্ড।
মুক্তার ব্যবসা ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের কেন্দ্র।
৩. নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্য
গ্রিড পদ্ধতি
সড়কগুলো উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে বিন্যস্ত, প্রায় সমকোণে ছেদ করা। প্রতিটি ব্লকে বাড়িগুলো একই রকম নকশায় নির্মিত।
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা
প্রতিটি বাড়িতে স্নানাগার এবং মেঝে নালি, যা প্রধান ড্রেনের সাথে যুক্ত। রাস্তার নীচে পাইপলাইন দ্বারা বর্জ্য নিষ্কাশন।
জল ব্যবস্থাপনা
কূপ, জলাধার, এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা। ধোলাবীরায় ১৬টি জলাধার ও বাঁধের নিদর্শন।
সামাজিক সমতা
প্রাসাদ বা মন্দিরের অভাব; ধর্মীয় বা প্রশাসনিক কেন্দ্রের চেয়ে নাগরিক সুবিধায় গুরুত্ব।
আমাদের সাথে telegram এ যুক্ত হন -- https://t.me/railwaysntpcbengali
আমাদের সাথে whatsapp এ যুক্ত হন--- https://whatsapp.com/channel/0029Vb2bIFU8PgsE1peYGE2c
৪. অর্থনীতি ও বাণিজ্য
কৃষি
গম, যব, খেজুর, তুলা চাষ। সিন্ধু অঞ্চলের উর্বর মাটি ও বন্যাপ্লাবিত জমি কৃষিতে সহায়ক। সেচের জন্য খাল নির্মাণ।
শিল্প ও কারুশিল্প
মৃৎশিল্প: লাল মাটির পাত্র, কালো রঙের নকশা।
ধাতুশিল্প: তামা, ব্রোঞ্জের সরঞ্জাম ও মূর্তি (যেমন "নর্তকী" মূর্তি)।
মুক্তা ও স্টিয়াটাইটের গহনা: সীলমোহরে ব্যবহৃত।
বাণিজ্য
আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য: নদীপথে কাঠ, ধাতু, ও পণ্য আদান-প্রদান।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য: মেসোপটেমিয়ার সাথে (আধুনিক ইরাক)। সীলমোহর, তুলা, এবং হাতির দাঁত রপ্তানি। লোথাল থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত জাহাজ চলাচল।
৫. সমাজ ও সংস্কৃতি
সামাজিক কাঠামো
কোনো স্পষ্ট শ্রেণিবিভাগের প্রমাণ নেই। সম্ভবত বণিক, শিল্পী, কৃষক, ও প্রশাসকদের সমন্বয়ে গঠিত।
ধর্ম ও বিশ্বাস
সীলমোহরে "পশুপতি" (প্রোটো-শিব) চিত্র: যোগীর ভঙ্গিতে বসা দেবতা, চারপাশে পশু।
মাতৃদেবীর মূর্তি ও প্রজনন প্রতীকের উপাসনা।
পরবর্তী হিন্দু ধর্মের সাথে সাদৃশ্য: পবিত্র গাছ, জল, এবং অগ্নি উপাসনা।
খেলাধুলা ও বিনোদন
পাশা খেলার নিদর্শন, মাটির খেলনা গাড়ি ও পুতুল।
নৃত্য ও সংগীতের চিত্র (নর্তকী মূর্তি)।
৬. লিপি ও ভাষা
সিন্ধু সভ্যতার লিপিতে ৪০০-৬০০ চিহ্ন রয়েছে, প্রধানত সীলমোহরে খোদাই করা। লিপিটি ডান থেকে বামে লেখা হতো। তবে এটি এখনো অপরিবর্তিত, কারণ কোনো দ্বিভাষিক শিলালিপি পাওয়া যায়নি। গবেষকদের অনুমান এটি একটি ড্রাভিডিয়ান বা প্রোটো-ইলামাইট ভাষা হতে পারে।
৭. পতনের কারণ
প্রাকৃতিক বিপর্যয়
সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়া: ভূগর্ভস্থ টেকটোনিক পরিবর্তন।
বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন: মোনসনের অনিয়মিততা ও মরুভূমির প্রসার।
বহিরাগত আক্রমণ
আর্য জাতির আগমন (বিতর্কিত): ঋগ্বেদে "পুর" ধ্বংসের বর্ণনা। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে হঠাৎ ধ্বংসের চেয়ে ধীর পতনের প্রমাণ বেশি।
অর্থনৈতিক অবনতি
বাণিজ্য পথের পরিবর্তন ও সম্পদ সংকট।
৮. ঐতিহ্য ও প্রভাব
হিন্দু সংস্কৃতিতে: শিবের ধারণা, স্নান rituals, পবিত্র গবাদি পশু।
নগর পরিকল্পনা: আধুনিক ড্রেনেজ সিস্টেমের পূর্বসূরি।
শিল্পে: টেরাকোটা শিল্প ও মৃৎশিল্পের ধারাবাহিকতা।
৯. অমীমাংসিত রহস্য
১. লিপির অর্থ ও ভাষা।
২. রাজনৈতিক কাঠামো: কেন্দ্রীয় শাসনের প্রমাণ নেই।
৩. ধর্মীয় প্রথার সম্পূর্ণ চিত্র।
৪. হঠাৎ পতনের সঠিক কারণ।
আমাদের সাথে telegram এ যুক্ত হন -- https://t.me/railwaysntpcbengali
আমাদের সাথে whatsapp এ যুক্ত হন--- https://whatsapp.com/channel/0029Vb2bIFU8PgsE1peYGE2c
উপসংহার
সিন্ধু সভ্যতা মানব ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়, যার প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সামাজিক সংগঠন আধুনিক সমাজকেও অনুপ্রাণিত করে। এর রহস্যময়তা গবেষকদের আজও মোহিত করে, প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের মাধ্যমে যা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। সিন্ধু সভ্যতা কেবল একটি অধ্যায় নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক DNA-এর অংশ।
No comments