ধর্ম ও দর্শন: একটি সামগ্রিক রূপরেখা
ধর্ম ও দর্শন: একটি সামগ্রিক রূপরেখা
ধর্ম ও দর্শন: একটি সামগ্রিক রূপরেখা
ভারতবর্ষ হলো পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা এবং বহু ধর্মের সূতিকাগার। হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম এবং শিখধর্মের জন্ম এই মাটিতেই, যা বিশ্বের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছে। পরবর্তীতে মধ্যযুগে সুফিবাদের আগমন ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এই বিস্তারিত আলোচনায় আমরা এই পাঁচটি ধর্ম ও দর্শনের মূল ভিত্তি, বিবর্তন এবং জীবনদর্শন সম্পর্কে জানব।
১. হিন্দুধর্ম (Hinduism): বিশ্বের প্রাচীনতম জীবনধারা
হিন্দুধর্ম কোনো একক ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট সময়ে প্রবর্তিত হয়নি। এটি সহস্রাব্দ ধরে বিকশিত একটি জটিল কিন্তু সুসংবদ্ধ জীবনদর্শন, যাকে 'সনাতন ধর্ম' বলা হয়।
মূল দর্শন ও শাস্ত্র
হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি হলো বেদ। বেদের চারটি ভাগ: ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। বেদের দার্শনিক অংশকে বলা হয় উপনিষদ, যেখানে ব্রহ্ম এবং আত্মার একত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ব্রহ্ম ও আত্মা: হিন্দুদর্শন অনুযায়ী, পরমেশ্বর বা 'ব্রহ্ম' নিরাকার এবং সর্বব্যাপী। প্রতিটি জীবের মধ্যে যে প্রাণশক্তি বিদ্যমান, তা-ই হলো 'আত্মা'। মোক্ষ বা মুক্তি হলো আত্মার সাথে ব্রহ্মের মিলন।
কর্মফল ও পুনর্জন্ম: "যেমন কর্ম, তেমন ফল"—এটিই হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। মানুষের বর্তমান জীবনের কর্ম পরবর্তী জীবনের গতি নির্ধারণ করে।
চতুর্বর্ণ ও চতুরাশ্রম: প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থায় চারটি বর্ণ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) এবং জীবনের চারটি পর্যায় (ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস) বর্ণিত ছিল।
প্রধান দেবদেবী ও শাখা
হিন্দুধর্মে ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপের উপাসনা করা হয়। প্রধান তিনটি রূপ হলো ব্রহ্মা (সৃষ্টি), বিষ্ণু (পালন) এবং শিব (ধ্বংস)। এছাড়াও শাক্ত (কালী বা দুর্গা), শৈব ও বৈষ্ণব—এই তিনটি প্রধান ধারা প্রচলিত।
ভগবদগীতা: মহাভারতের এই অংশটি হিন্দুধর্মের সারসংক্ষেপ হিসেবে পরিচিত। এতে নিষ্কাম কর্ম এবং ভক্তিযোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
২. বৌদ্ধধর্ম (Buddhism): শান্তির পথ
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধের হাত ধরে বৌদ্ধধর্মের প্রচার শুরু হয়। এটি মূলত একটি সংস্কারমূলক ধর্ম যা তৎকালীন বৈদিক ধর্মের জটিল যাগযজ্ঞের পরিবর্তে নির্বাণ লাভের সহজ পথের কথা বলে।
গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা
গৌতম বুদ্ধ ভোগবিলাস এবং কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন—এই দুটির মাঝামাঝি পথ বা 'মধ্যমপন্থা' (Middle Way) অবলম্বনের কথা বলেছেন।
চারটি আর্য সত্য (Four Noble Truths)
১. দুঃখ: জগত দুঃখময়।
২. দুঃখ সমুদয়: দুঃখের কারণ হলো তৃষ্ণা বা আকাঙ্ক্ষা।
৩. দুঃখ নিরোধ: আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করলেই দুঃখ থেকে মুক্তি সম্ভব।
৪. দুঃখ নিরোধগামিনী প্রতিপদ: দুঃখমুক্তির জন্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করা প্রয়োজন।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ
সৎ দৃষ্টি, সৎ সংকল্প, সৎ বাক্য, সৎ কর্ম, সৎ আজীবিকা, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ স্মৃতি এবং সৎ সমাধি।
প্রধান সম্প্রদায়
হীনযান: বুদ্ধের মূল শিক্ষাকে কঠোরভাবে মেনে চলে।
মহাযান: বুদ্ধকে দেবতা হিসেবে পূজা করে এবং মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী।
বজ্রযান: তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম যা তিব্বত ও নেপালে জনপ্রিয়।
৩. জৈনধর্ম (Jainism): অহিংসা ও ত্যাগ
জৈনধর্ম বৌদ্ধধর্মের সমসাময়িক এবং চরম অহিংসা ও ত্যাগের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। জৈনধর্মের ২৪ জন ধর্মগুরুকে 'তীর্থঙ্কর' বলা হয়। প্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন ঋষভদেব এবং ২৪তম ও শেষ তীর্থঙ্কর ছিলেন মহাবীর বর্ধমান।
মূল দর্শন: ত্রিরত্ন
জৈনধর্মে মুক্তির জন্য তিনটি রত্ন বা 'ত্রিরত্ন' মেনে চলা বাধ্যতামূলক:
১. সম্যক দর্শন: সঠিক বিশ্বাস।
২. সম্যক জ্ঞান: সঠিক জ্ঞান।
৩. সম্যক চরিত্র: সঠিক আচরণ।
পঞ্চ মহাব্রত
জৈন সন্ন্যাসীদের পাঁচটি কঠোর নিয়ম পালন করতে হয়:
১. অহিংসা: কোনো প্রাণীকে কষ্ট না দেওয়া।
২. সত্য: সর্বদা সত্য বলা।
৩. অচৌর্য: চুরি না করা।
৪. ব্রহ্মচর্য: পবিত্র জীবন যাপন।
৫. অপরিগ্রহ: কোনো সম্পত্তি বা মায়া ত্যাগ করা।
জৈনধর্মের শাখা
জৈনধর্ম মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত:
দিগম্বর: যারা কোনো পোশাক পরিধান করেন না এবং কঠোর নিয়ম মানেন।
শ্বেতাম্বর: যারা সাদা কাপড় পরিধান করেন এবং তুলনামূলক সহজ নিয়ম মানেন।
৪. শিখধর্ম (Sikhism): সাম্য ও সেবার ধর্ম
১৫শ শতাব্দীতে পাঞ্জাবের মাটিতে গুরু নানক দেব শিখধর্ম প্রবর্তন করেন। এটি একটি একত্ববাদী ধর্ম যা বর্ণপ্রথা ও বাহ্যিক আড়ম্বরের ঘোর বিরোধী।
গুরু ও শিক্ষা
শিখধর্মে মোট ১০ জন গুরু রয়েছেন। দশম গুরু, গুরু গোবিন্দ সিং, তাঁর পরে পবিত্র গ্রন্থ 'গুরু গ্রন্থ সাহেব'-কে চিরস্থায়ী গুরু হিসেবে ঘোষণা করেন।
শিখধর্মের মূল আদর্শ
এক ওঙ্কার: ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়।
সেবা ও লঙ্গর: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে বিনামূল্যে খাবার খাওয়ানো বা সেবা করা। এটি সাম্যের প্রতীক।
৫টি 'ক' (Panj Kakar): প্রতিটি অমৃতধারী শিখকে পাঁচটি প্রতীক ধারণ করতে হয়:
১. কেশ: না কাটা চুল।
২. কঙ্গা: কাঠের চিরুনি।
৩. কারা: লোহার বালা।
৪. কাছা: বিশেষ অন্তর্বাস।
৫. কৃপাণ: ছোট তলোয়ার বা ছুরি।
৫. সুফিবাদ (Sufism): আধ্যাত্মিক প্রেম ও মিলন
সুফিবাদ হলো ইসলামের একটি মরমী ও আধ্যাত্মিক ধারা। এটি মূলত আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে মনের শুদ্ধি এবং স্রষ্টার প্রতি গভীর ভালোবাসার ওপর জোর দেয়। মধ্যযুগে ভারতে ইসলাম প্রসারে সুফি সাধকদের ভূমিকা ছিল অনন্য।
মূল দর্শন
সুফিবাদের মূল কথা হলো 'ইশক-এ-হাকিকি' বা পরমেশ্বরের প্রতি ভালোবাসা। তাদের মতে, স্রষ্টাকে ভয় দিয়ে নয়, বরং প্রেম দিয়ে জয় করা সম্ভব।
পির-মুরিদ সম্পর্ক: সুফিবাদে একজন গুরু বা 'পির' (বা মুর্শিদ) এর অধীনে শিষ্য বা 'মুরিদ' আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন।
জিকির ও সামা: স্রষ্টাকে স্মরণের জন্য জিকির এবং আধ্যাত্মিক সংগীত বা 'সামা' (কাওয়ালি) সুফি ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রধান সুফি সিলসিলা (সম্প্রদায়)
১. চিশতিয়া: খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি ভারতে এই সিলসিলার প্রবর্তন করেন। তারা অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন।
২. সুহরাওয়ার্দী: এই সম্প্রদায়ের সাধকরা কিছুটা বিলাসিতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকতেন।
৩. নকশবন্দি: এরা তুলনামূলক রক্ষণশীল এবং শরীয়ত পালনে কঠোর।
তুলনা ও সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ
ধর্ম মূল প্রচারক/ভিত্তি প্রধান লক্ষ্য বিশেষ বৈশিষ্ট্য
হিন্দুধর্ম ঋষি ও বেদ মোক্ষ বা মুক্তি কর্মফল, বহু দেবদেবী ও অদ্বৈতবাদ
বুদ্ধধর্ম গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ অহিংসা ও অষ্টাঙ্গিক মার্গ
জৈনধর্ম মহাবীর বর্ধমান কৈবল্য চরম ত্যাগ ও অহিংসা
শিখধর্ম গুরু নানক দেব ঈশ্বরের সাথে মিলন সাম্য, সেবা ও ৫টি 'ক'
সুফিবাদ সুফি সাধকগণ ফানা (স্রষ্টায় বিলীন হওয়া) প্রেম, সংগীত ও পির-ভক্তি
উপসংহার
উপরোক্ত প্রতিটি ধর্ম ও দর্শন ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণ করলেও তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের নৈতিক উন্নয়ন এবং পরম সত্যের অনুসন্ধান। হিন্দুধর্মের উদারতা, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের অহিংসা, শিখধর্মের সেবা এবং সুফিবাদের প্রেম—সবই মিলেমিশে ভারতীয় সংস্কৃতির এক বৈচিত্র্যময় ও সহনশীল রূপ তৈরি করেছে। এই ধর্মগুলোর শিক্ষা আজও আমাদের মানবিক সমাজ গঠনে অনুপ্রেরণা জোগায়।
No comments