পদার্থের পারমাণবিক গঠন: একটি বিস্তারিত আলোচনা
পদার্থের পারমাণবিক গঠন: একটি বিস্তারিত আলোচনা
পদার্থের মূল গঠন বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে পরমাণুর গঠন সম্পর্কে। পরমাণু হলো পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক, যা রাসায়নিকভাবে বিভাজ্য নয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, পরমাণুও ইলেকট্রন, প্রোটন, ও নিউট্রন নামক উপ-পরমাণবিক কণায় বিভক্ত। এই আলোচনায় আমরা পদার্থের পারমাণবিক গঠনের ইতিহাস, উপাদান, মডেল, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভূমিকা, এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে বিস্তারিত জানব।
১. পারমাণবিক তত্ত্বের ঐতিহাসিক বিকাশ
ক. প্রাচীন ধারণা
দেমোক্রিটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০): প্রথম "পরমাণু" শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পরমাণু অবিভাজ্য এবং শূন্যস্থানে চলাচল করে।
জন ডাল্টন (১৮০৮): আধুনিক পারমাণবিক তত্ত্বের জনক। তাঁর মতে:
১. সকল পদার্থ পরমাণু দিয়ে গঠিত।
২. একই মৌলের পরমাণু অভিন্ন, ভিন্ন মৌলের ভিন্ন।
৩. পরমাণু বিভাজ্য নয়।
আমাদের সাথে telegram এ যুক্ত হন -- https://t.me/railwaysntpcbengali
আমাদের সাথে whatsapp এ যুক্ত হন--- https://whatsapp.com/channel/0029Vb2bIFU8PgsE1peYGE2c
খ. উপ-পরমাণবিক কণার আবিষ্কার
জে.জে. টমসন (১৮৯৭): ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। ক্যাথোড রশ্মি পরীক্ষায় দেখা যায়, ইলেকট্রন ঋণাত্মক আধান বহন করে।
আর্নেস্ট রাদারফোর্ড (১৯১১): গোল্ড ফয়েল পরীক্ষা-এর মাধ্যমে পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার। তিনি প্রমাণ করেন, পরমাণুর বেশিরভাগ স্থান ফাঁকা, এবং ধনাত্মক আধান কেন্দ্রীভূত।
জেমস চ্যাডউইক (১৯৩২): নিউট্রন আবিষ্কার, যা নিউক্লিয়াসে অবস্থিত এবং আধানবিহীন।
গ. আধুনিক মডেল
নিলস বোর (১৯১৩): ইলেকট্রন নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে বলে প্রস্তাব করেন (বোর মডেল)।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স (১৯২০-এর দশক): শ্রোডিঙার, হাইজেনবার্গ প্রমুখ বিজ্ঞানী প্রমাণ করেন, ইলেকট্রনের অবস্থান সম্ভাবনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় (অরবিটাল মডেল)।
২. পরমাণুর উপাদান
ক. উপ-পরমাণবিক কণা
কণা | আধান | ভর (কিলোগ্রাম) | অবস্থান |
---|---|---|---|
প্রোটন | +1.6×10⁻¹⁹ C | 1.6726×10⁻²⁷ | নিউক্লিয়াস |
নিউট্রন | ০ | 1.6749×10⁻²⁷ | নিউক্লিয়াস |
ইলেকট্রন | -1.6×10⁻¹⁹ C | 9.109×10⁻³¹ | নিউক্লিয়াসের বাইরে |
খ. নিউক্লিয়াস
প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে গঠিত।
পারমাণবিক সংখ্যা (Z): প্রোটনের সংখ্যা (মৌলের পরিচায়ক)।
ভর সংখ্যা (A): প্রোটন + নিউট্রনের সংখ্যা।
গ. আইসোটোপ
একই মৌলের পরমাণু যাদের নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন (যেমন: কার্বন-১২ ও কার্বন-১৪)।
উদাহরণ: ইউরেনিয়াম-২৩৫ (নিউক্লিয়ার ফিশনে ব্যবহৃত)।
৩. পারমাণবিক মডেলের বিবর্তন
ক. টমসনের প্লাম পুডিং মডেল (১৯০৪)
পরমাণুকে ধনাত্মক আধানের গোলক হিসেবে বর্ণনা, যাতে ইলেকট্রন গুঁজে দেওয়া আছে।
খ. রাদারফোর্ডের নিউক্লিয়ার মডেল (১৯১১)
গোল্ড ফয়েল পরীক্ষা: আলফা কণার বিক্ষেপণ দেখে নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ব প্রমাণ।
সীমাবদ্ধতা: ইলেকট্রনের স্থিতিশীলতা ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
গ. বোরের পরমাণু মডেল (১৯১৩)
ইলেকট্রন নির্দিষ্ট কক্ষপথে (শক্তিস্তরে) ঘোরে এবং শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে।
সূত্র: (হাইড্রোজেন পরমাণুর জন্য)।
ঘ. কোয়ান্টাম মেকানিকাল মডেল (১৯২৬)
শ্রোডিঙারের সমীকরণ: ইলেকট্রনের তরঙ্গ ফাংশন () দ্বারা অবস্থানের সম্ভাবনা বর্ণনা।
অরবিটাল: ইলেকট্রন পাওয়ার ৯০% সম্ভাবনার অঞ্চল (s, p, d, f আকৃতির)।
৪. কোয়ান্টাম সংখ্যা ও ইলেকট্রন বিন্যাস
ক. কোয়ান্টাম সংখ্যার প্রকারভেদ
১. প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা (n): শক্তিস্তর নির্দেশ করে (1, 2, 3,...)।
২. অ্যাজিমুথাল কোয়ান্টাম সংখ্যা (l): অরবিটালের আকৃতি (s=0, p=1, d=2, f=3)।
৩. ম্যাগনেটিক কোয়ান্টাম সংখ্যা (mₗ): অরবিটালের অভিমুখ (-l থেকে +l)।
৪. স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা (mₛ): ইলেকট্রনের ঘূর্ণন (+½ বা -½)।
খ. ইলেকট্রন বিন্যাসের নীতি
পাউলির বর্জন নীতি: একই পরমাণুর দুটি ইলেকট্রনের চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা সমান হতে পারবে না।
হুন্ডের নিয়ম: একই শক্তিস্তরে অরবিটাল পূরণের সময় সর্বোচ্চ স্পিন বজায় রাখা।
আউফবাউ নীতি: নিম্ন শক্তির অরবিটাল প্রথমে পূর্ণ হয়।
গ. উদাহরণ: কার্বন (C) পরমাণু
পারমাণবিক সংখ্যা = 6 → ইলেকট্রন বিন্যাস: .
আমাদের সাথে telegram এ যুক্ত হন -- https://t.me/railwaysntpcbengali
আমাদের সাথে whatsapp এ যুক্ত হন--- https://whatsapp.com/channel/0029Vb2bIFU8PgsE1peYGE2c
৫. পারমাণবিক বন্ধন ও রাসায়নিক বিক্রিয়া
ক. আয়নিক বন্ধন
ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নের মধ্যে স্থির বিদ্যুৎ আকর্ষণ (যেমন: NaCl)।
খ. সমযোজী বন্ধন
ইলেকট্রনের ভাগাভাগির মাধ্যমে গঠিত (যেমন: H₂O)।
গ. ধাতব বন্ধন
ধাতব পরমাণুর ইলেকট্রন সাগরে ধনাত্মক আয়ন নিমজ্জিত থাকে।
ঘ. রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভূমিকা
ইলেকট্রন আদান-প্রদানের মাধ্যমে নতুন যৌগ গঠন (যেমন: )।
৬. পারমাণবিক শক্তি ও প্রযুক্তি
ক. নিউক্লিয়ার ফিশন
ভারী নিউক্লিয়াস (যেমন: ইউরেনিয়াম-২৩৫) ভেঙে শক্তি উৎপাদন।
অ্যাপ্লিকেশন: পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
খ. নিউক্লিয়ার ফিউশন
হালকা নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে শক্তি নির্গমন (সূর্যের শক্তির উৎস)।
চ্যালেঞ্জ: উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপ নিয়ন্ত্রণ।
গ. রেডিওআইসোটোপের ব্যবহার
চিকিৎসা: ক্যান্সার থেরাপি (কোবাল্ট-৬০)।
প্রত্নতত্ত্ব: কার্বন-১৪ ডেটিং।
৭. আধুনিক গবেষণা ও ভবিষ্যৎ
ক. কোয়ান্টাম কম্পিউটিং
পরমাণুর কোয়ান্টাম অবস্থা (সুপারপজিশন, এনট্যাঙ্গেলমেন্ট) ব্যবহার করে গণনা।
খ. ন্যানোপ্রযুক্তি
পরমাণু স্তরে পদার্থ নিয়ন্ত্রণ (যেমন: কার্বন ন্যানোটিউব)।
গ. হিগস বোসন
২০১২ সালে CERN-এ আবিষ্কৃত, যা ভর সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন করে।
৮. উপসংহার
পারমাণবিক গঠনের জ্ঞান আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তি তৈরি করেছে। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জৈবপ্রযুক্তি, এমনকি মহাকাশ গবেষণায় এর প্রভাব অপরিসীম। ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও ন্যানোটেকনোলজির উন্নতির সাথে পদার্থের গঠন সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া আরও গভীর হবে, যা নতুন বিপ্লবের সূচনা করবে।
No comments