অ্যাসিড, ক্ষারক ও লবণ । acid , base , salt

 রসায়ন বিজ্ঞানের তিনটি মৌলিক ধারণা হলো অ্যাসিড, ক্ষারক ও লবণ। এগুলি আমাদের দৈনন্দিন জীবন, শিল্পক্ষেত্র এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচে এগুলির বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

WhatsApp Join Now

Telegram Join Now

১. অ্যাসিড (Acid)

সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

অ্যাসিড হলো এমন রাসায়নিক যৌগ যা জলে দ্রবীভূত হয়ে হাইড্রোজেন আয়ন (H⁺) প্রদান করে এবং ক্ষারকের সাথে বিক্রিয়া করে লবণ ও জল উৎপন্ন করে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:

• স্বাদে টক (যেমন: লেবুতে সাইট্রিক অ্যাসিড)।

• নীল লিটমাস পেপারকে লাল করে।

• ধাতুর সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন গ্যাস নির্গত করে (যেমন: দস্তা + সালফিউরিক অ্যাসিড → জিঙ্ক সালফেট + H₂)।

• ত্বকে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে (শক্তিশালী অ্যাসিড, যেমন: H₂SO₄)।

অ্যাসিডের শ্রেণিবিভাগ

১. উৎস অনুযায়ী:

• প্রাকৃতিক অ্যাসিড: লেবু (সাইট্রিক অ্যাসিড), টকদই (ল্যাকটিক অ্যাসিড)।

• খনিজ অ্যাসিড: সালফিউরিক অ্যাসিড (H₂SO₄), হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCl)।

২. শক্তির ভিত্তিতে:

• প্রবল অ্যাসিড: সম্পূর্ণরূপে আয়নিত হয় (যেমন: HCl, HNO₃)।

• দুর্বল অ্যাসিড: আংশিক আয়নিত হয় (যেমন: CH₃COOH)।

৩. অণুতে অক্সিজেনের উপস্থিতি:

• অক্সি-অ্যাসিড: H₂SO₄, HNO₃।

• হাইড্রো-অ্যাসিড: HCl, HBr।

অ্যাসিডের তত্ত্ব

১. আরহেনিয়াস তত্ত্ব (1887): অ্যাসিড হলো এমন পদার্থ যা জলে H⁺ আয়ন উৎপন্ন করে।
২. ব্রনস্টেড-লাউরি তত্ত্ব (1923): অ্যাসিড হলো প্রোটন দাতা (H⁺ দান করে)।
৩. লুইস তত্ত্ব (1923): অ্যাসিড হলো ইলেকট্রন জোড় গ্রহীতা।

গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসিড ও ব্যবহার

• সালফিউরিক অ্যাসিড (H₂SO₄): ব্যাটারি, সার উৎপাদন।

• হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCl): পাকস্থলীর পরিপাক রস।

• নাইট্রিক অ্যাসিড (HNO₃): বিস্ফোরক ও সার তৈরিতে।

২. ক্ষারক (Base)

সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

ক্ষারক হলো এমন পদার্থ যা অ্যাসিডের সাথে বিক্রিয়া করে লবণ ও জল উৎপন্ন করে এবং জলে দ্রবীভূত হয়ে হাইড্রোক্সাইড আয়ন (OH⁻) প্রদান করে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:

• স্বাদে তিক্ত এবং স্পর্শে মসৃণ (যেমন: সাবান)।

• লাল লিটমাস পেপারকে নীল করে।

• ত্বকে কস্টিক প্রভাব ফেলতে পারে (যেমন: NaOH)।

ক্ষারকের শ্রেণিবিভাগ

১. শক্তির ভিত্তিতে:

• প্রবল ক্ষারক: সম্পূর্ণ আয়নিত (যেমন: NaOH, KOH)।

• দুর্বল ক্ষারক: আংশিক আয়নিত (যেমন: NH₄OH)।

২. দ্রাব্যতা অনুযায়ী:

• জলে দ্রবণীয় (ক্ষার): NaOH, KOH।

• জলে অদ্রবণীয়: Mg(OH)₂, Al(OH)₃।

ক্ষারকের তত্ত্ব

১. আরহেনিয়াস তত্ত্ব: ক্ষারক জলে OH⁻ আয়ন দেয়।
২. ব্রনস্টেড-লাউরি তত্ত্ব: ক্ষারক প্রোটন গ্রহীতা (H⁺ গ্রহণ করে)।
৩. লুইস তত্ত্ব: ক্ষারক ইলেকট্রন জোড় দাতা।

গুরুত্বপূর্ণ ক্ষারক ও ব্যবহার

• সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH): সাবান, কাগজ শিল্প।

• ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড (Ca(OH)₂): নির্মাণ কাজে (চুন)।

• অ্যামোনিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NH₄OH): সার ও ক্লিনিং এজেন্ট।

৩. লবণ (Salt)

সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

লবণ হলো অ্যাসিড ও ক্ষারকের প্রশমন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন নিরপেক্ষ যৌগ, যা ধনাত্মক ধাতব আয়ন (ক্যাটায়ন) ও ঋণাত্মক অ্যাসিড আয়ন (অ্যানায়ন) দ্বারা গঠিত।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:

• স্ফটিকাকার কঠিন (যেমন: NaCl)।

• জলে দ্রবণীয় হলে বিদ্যুৎ পরিবহন করে।

• pH মান নিরপেক্ষ, অম্লীয় বা ক্ষারকীয় হতে পারে।

লবণের প্রকারভেদ

১. সাধারণ লবণ: NaCl, KNO₃ (নিরপেক্ষ)।
২. অম্লীয় লবণ: NaHSO₄ (অতিরিক্ত H⁺ থাকলে)।
৩. ক্ষারকীয় লবণ: Mg(OH)Cl (অতিরিক্ত OH⁻ থাকলে)।
৪. ডবল লবণ: KAl(SO₄)₂·12H₂O (পটাশ অ্যালাম)।
৫. জটিল লবণ: [Cu(NH₃)₄]SO₄ (কমপ্লেক্স আয়নযুক্ত)।

লবণের প্রস্তুতি

১. অ্যাসিড + ক্ষারক:
$\text{HCl}+\text{NaOH}\to \text{NaCl}+\text{H₂O}$
২. অ্যাসিড + ধাতু:
$\text{Zn}+\text{H₂SO₄}\to \text{ZnSO₄}+\text{H₂}$
৩. অ্যাসিড + ধাতব কার্বনেট:
$\text{CaCO₃}+\text{2HCl}\to \text{CaCl₂}+\text{CO₂}+\text{H₂O}$

গুরুত্বপূর্ণ লবণ ও ব্যবহার

• সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl): খাদ্য সংরক্ষণ, রান্না।

• ক্যালসিয়াম সালফেট (CaSO₄): প্লাস্টার অফ প্যারিস।

• পটাসিয়াম নাইট্রেট (KNO₃): সার ও বারুদের উপাদান।

৪. pH স্কেল ও নির্দেশক

pH স্কেল

পদার্থের অম্লীয় বা ক্ষারকীয় মাত্রা পরিমাপের লগারিদমিক স্কেল (0-14):

• pH < 7: অম্লীয় (যেমন: লেবুর রস, pH ≈ 2)।

• pH = 7: নিরপেক্ষ (জল)।

• pH > 7: ক্ষারকীয় (সাবান, pH ≈ 10)।

নির্দেশকের প্রকারভেদ

• প্রাকৃতিক নির্দেশক: লিটমাস (লাইকেন থেকে প্রাপ্ত), হলুদ।

• সিন্থেটিক নির্দেশক: ফেনলফথালেইন (ক্ষারকীয়ে গোলাপী), মিথাইল অরেঞ্জ।

• সার্বজনীন নির্দেশক: pH মান অনুযায়ী বিভিন্ন রং দেখায়।

৫. প্রশমন বিক্রিয়া ও প্রয়োগ

প্রশমন বিক্রিয়া

অ্যাসিড ও ক্ষারকের বিক্রিয়ায় লবণ ও জল উৎপন্ন হয়:
$\text{HCl}+\text{NaOH}\to \text{NaCl}+\text{H₂O}$

প্রয়োগ

• অ্যান্টাসিড: পাকস্থলীর অতিরিক্ত অ্যাসিড নিরপেক্ষ করে (Mg(OH)₂)।

• মৃত্তিকা চিকিৎসা: অম্লীয় মাটিতে চুন (CaO) প্রয়োগ।

• রাসায়নিক সার: অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট (NH₄NO₃)।

৬. অ্যাসিড-ক্ষারক রসায়নের দৈনন্দিন ব্যবহার

• খাদ্য সংরক্ষণ: ভিনেগার (অ্যাসিটিক অ্যাসিড) ব্যবহার।
  

  WhatsApp Join Now
  Telegram Join Now
  
  

• ক্লিনিং এজেন্ট: বেকিং সোডা (NaHCO₃) চর্বি দূর করে।

• কৃষি: ফসফরিক অ্যাসিড সার হিসাবে।

৭. সতর্কতা

• অ্যাসিড/ক্ষারক সংরক্ষণ: কাচের পাত্রে রাখা উচিত, কারণ প্লাস্টিক বিক্রিয়া করতে পারে।

• ত্বক সংস্পর্শ: গ্লাভস ও গগলস ব্যবহার আবশ্যক।

৮. রসায়নের আধুনিক প্রয়োগ

• বাফার দ্রবণ: রক্তের pH নিয়ন্ত্রণ (HCO₃⁻/H₂CO₃)।

• জৈব রসায়ন: এনজাইমের ক্রিয়া pH-নির্ভর।

উপসংহার

অ্যাসিড, ক্ষারক ও লবণের সঠিক জ্ঞান রসায়ন, চিকিৎসা, শিল্প এবং পরিবেশ বিজ্ঞানের জন্য অপরিহার্য। এগুলির বৈশিষ্ট্য, বিক্রিয়া ও প্রয়োগ বোঝা আধুনিক প্রযুক্তি ও টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি।

WhatsApp Join Now

Telegram Join Now