সংবহন : জীবনপ্রবাহের অদৃশ্য নেটওয়ার্ক । Circulation
সংবহন: জীবনপ্রবাহের অদৃশ্য নেটওয়ার্ক
সংবহন: জীবনপ্রবাহের অদৃশ্য নেটওয়ার্ক
একটি সম্পূর্ণ গাইড যা আপনার স্বাস্থ্য ও চাকরির প্রস্তুতিকে করবে সমৃদ্ধ
ভূমিকা
সংবহন তন্ত্র হল শরীরের পরিবহন ব্যবস্থা, যা অক্সিজেন, পুষ্টি, হরমোন ও বর্জ্য পদার্থকে কোষে পৌঁছে দেয় এবং অপসারণ করে। এই ব্যবস্থা ছাড়া দেহের কোষগুলি কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যেত। এই ব্লগে আমরা মানব ও উদ্ভিদের সংবহন প্রক্রিয়া, হৃদরোগ, রক্তের গঠন এবং আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
১. সংবহন তন্ত্র: প্রকারভেদ ও উপাদান
WhatsApp
Join Now
Telegram
Join Now
সংবহন কী?
সংবহন হল রক্ত, লসিকা ও অন্যান্য তরলের মাধ্যমে দেহে পদার্থের প্রবাহ। এটি দুই প্রকার:
রক্ত সংবহন: হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালীর মাধ্যমে।
লসিকা সংবহন: লসিকানালী ও লসিকাগ্রন্থির মাধ্যমে।
মানব সংবহন তন্ত্রের প্রধান অঙ্গ
হৃৎপিণ্ড: চার প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট পাম্পিং অঙ্গ।
রক্তনালী: ধমনী, শিরা ও কৈশিকনালী।
রক্ত: প্লাজমা, লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা ও অণুচক্রিকা।
২. হৃৎপিণ্ড: গঠন ও কার্যক্রম
হৃৎপিণ্ডের গঠন
প্রকোষ্ঠ: ২ অলিন্দ (আট্রিয়াম) ও ২ নিলয় (ভেন্ট্রিকল)।
কপাটিকা: ট্রাইকাসপিড, মাইট্রাল, পালমোনারি ও অ্যাওর্টিক ভাল্ব।
রক্ত প্রবাহ পথ:
ডান অলিন্দ → ডান নিলয় → ফুসফুসীয় ধমনী → ফুসফুস → অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত।
বাম অলিন্দ → বাম নিলয় → মহাধমনী → সমগ্র দেহ।
হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ
SA নোড (পেসমেকার): হৃৎপিণ্ডের বৈদ্যুতিক সংকেত শুরু করে।
ECG (ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম): হৃৎপিণ্ডের তড়িৎক্রিয়া রেকর্ড করে।
৩. রক্ত: জীবনরসের গঠন
রক্তের উপাদান
উপাদান | ভূমিকা | মাত্রা |
---|---|---|
প্লাজমা (৫৫%) | পুষ্টি, হরমোন, বর্জ্য বহন | জল, প্রোটিন, ইলেক্ট্রোলাইট |
লোহিত কণিকা | অক্সিজেন পরিবহন (হিমোগ্লোবিন) | ৪.৫–৬ মিলিয়ন/µL |
শ্বেত কণিকা | রোগ প্রতিরোধ (নিউট্রোফিল, লিম্ফোসাইট) | ৪,০০০–১১,০০০/µL |
অণুচক্রিকা | রক্ত জমাট বাঁধা | ১.৫–৪.৫ লাখ/µL |
রক্তের গ্রুপ ও Rh ফ্যাক্টর
গ্রুপ: A, B, AB, O (এ্যান্টিজেনের ভিত্তিতে)।
Rh ফ্যাক্টর: Rh+ (৮৫% মানুষ), Rh– (১৫%)।
সার্বজনীন দাতা: O–, সার্বজনীন গ্রহীতা: AB+।
৪. রক্তনালী: ধমনী, শিরা ও কৈশিক
ধমনী (Artery)
কাজ: অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে দেহে বহন।
গঠন: পুরু পেশীস্তর (উচ্চ চাপ সহ্য)।
উদাহরণ: মহাধমনী, ফুসফুসীয় ধমনী।
শিরা (Vein)
কাজ: অক্সিজেনহীন রক্ত দেহ থেকে হৃৎপিণ্ডে ফেরত আনে।
গঠন: ভাল্বযুক্ত (নিম্ন চাপে প্রবাহ)।
উদাহরণ: মহাশিরা, জুগুলার শিরা।
কৈশিক (Capillary)
কাজ: কোষে পুষ্টি ও গ্যাস বিনিময়।
বৈশিষ্ট্য: এককোষী প্রাচীর, ব্যাস ৫–১০ মাইক্রোমিটার।
৫. লসিকা সংবহন: দ্বিতীয় পরিবহন ব্যবস্থা
লসিকার ভূমিকা
অনাক্রম্যতা: লিম্ফোসাইট উৎপাদন (টি-কোষ, বি-কোষ)।
তরল ভারসাম্য: টিস্যু থেকে অতিরিক্ত তরল ফেরত আনে।
চর্বি শোষণ: অন্ত্র থেকে চর্বি লসিকায় শোষিত হয়।
লসিকা অঙ্গ
লসিকাগ্রন্থি: টনসিল, প্লীহা, থাইমাস।
লসিকানালী: ডান লসিকা নালী, বক্ষ নালী।
৬. উদ্ভিদের সংবহন: জাইলেম ও ফ্লোয়েম
জাইলেম (Xylem)
কাজ: মূল থেকে জল ও খনিজ পাতায় পরিবহন।
গঠন: ট্রাকেইডস, ভেসেলস (মৃত কোষ)।
ফ্লোয়েম (Phloem)
কাজ: পাতায় তৈরি খাদ্য সমগ্র দেহে পরিবহন।
গঠন: সিভ টিউব, সঙ্গীকোষ (জীবিত কোষ)।
ট্রান্সপিরেশন ও প্রস্বেদন
ট্রান্সপিরেশন: পাতার স্টোমাটা দিয়ে জল বাষ্পীভূত হয় → জাইলেমে টান তৈরি।
গাটেশন: মূল চাপে অতিরিক্ত জল পাতার প্রান্তে ফোটায় নির্গত হয়।
৭. সংবহনজনিত রোগ ও প্রতিকার
হৃদরোগ
করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD):
কারণ: ধমনীতে প্লাক জমা → রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত।
লক্ষণ: বুকে ব্যথা (অ্যানজাইনা), শ্বাসকষ্ট।
চিকিৎসা: অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, বাইপাস সার্জারি।
হার্ট অ্যাটাক:
কারণ: করোনারি ধমনী সম্পূর্ণ বন্ধ → হৃৎপেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
জরুরি চিকিৎসা: CPR, থ্রম্বোলাইটিক ড্রাগ।
রক্ত সম্পর্কিত রোগ
অ্যানিমিয়া: হিমোগ্লোবিন কম → ক্লান্তি, ফ্যাকাশে ত্বক।
লিউকেমিয়া: শ্বেত কণিকার ক্যান্সার → রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা হ্রাস।
থ্যালাসেমিয়া: হিমোগ্লোবিন জিন ত্রুটি → লোহিত কণিকা ভঙ্গুর।
রক্তচাপের অস্বাভাবিকতা
হাইপারটেনশন: BP > ১৪০/৯০ mmHg → স্ট্রোক, কিডনি রোগের ঝুঁকি।
হাইপোটেনশন: BP < ৯০/৬০ mmHg → মাথা ঘোরা, দুর্বলতা।
৮. আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি
হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট
প্রক্রিয়া: মৃত দাতার হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন।
চ্যালেঞ্জ: দাতা-গ্রহীতা ম্যাচিং, প্রত্যাখ্যান রোধ।
আর্টিফিশিয়াল হার্ট
যন্ত্র: LVAD (Left Ventricular Assist Device), টোটাল আর্টিফিশিয়াল হার্ট।
ব্যবহার: ট্রান্সপ্লান্টের আগে অন্তর্বর্তীকালীন সমাধান।
স্টেম সেল থেরাপি
উদ্দেশ্য: ক্ষতিগ্রস্ত হৃৎপেশি পুনর্জন্ম।
গবেষণা: ইঁদুরে সফল, মানবদেহে ট্রায়াল চলছে।
৯. সংবহন তন্ত্রের যত্ন: প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ
জীবনযাত্রার পরিবর্তন
খাদ্যাভ্যাস: কম লবণ, কম চর্বি, শাকসবজি, ওমেগা-৩।
ব্যায়াম: সপ্তাহে ১৫০ মিনিট অ্যারোবিক এক্সারসাইজ (例: হাঁটা, সাইক্লিং)।
ধূমপান ত্যাগ: ধমনী সংকোচন রোধ।
নিয়মিত চেকআপ
রক্তচাপ: মাসে একবার মাপুন।
লিপিড প্রোফাইল: বছরে একবার টেস্ট (LDL, HDL, ট্রাইগ্লিসারাইড)।
ECG & Echo: হৃদরোগের ইতিহাস থাকলে নিয়মিত স্ক্রিনিং।
১০. প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
প্রশ্ন: রক্তে HDL ও LDL এর পার্থক্য কী?
উত্তর: HDL ("ভালো কোলেস্টেরল") ধমনী থেকে কোলেস্টেরল সরায়, LDL ("খারাপ") জমায়।প্রশ্ন: স্টেন্টিং কি স্থায়ী সমাধান?
উত্তর: হ্যাঁ, তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন জরুরি, পুনরায় ব্লকেজ হতে পারে।প্রশ্ন: উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ঘরোয়া উপায় কী?
উত্তর: রসুন, কলা (পটাসিয়াম), মেডিটেশন।
উপসংহার
সংবহন তন্ত্র শুধু জীবনধারণেরই নয়, সুস্থ জীবনের ভিত্তি। হৃদরোগ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ, কিন্তু সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এই গাইড আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করবে ।
সূত্র: NCERT Biology, American Heart Association, WHO, Nature Journal.
No comments