Header Ads

প্রসঙ্গ : ভূগোলে রাশিমাত্রিক বিপ্লব । Quantitative Revolution in bengali

প্রসঙ্গ : ভূগোলে রাশিমাত্রিক বিপ্লব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশেষত ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে ভৌগোলিকরা ভূগোল শাস্ত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব অনুভব করেন। এজন্য ভূগোল সমীক্ষার পদ্ধতি ও উদ্দেশ্যকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন সাধন করা হয়, তা রাশিমাত্রিক বিপ্লব (Quantitative Revolution) নামে পরিচিত। 

উদ্দেশ্যঃ- রাশিমাত্রিক বিপ্লবের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি হল -- (১) কোনো অঞ্চলের বিভিন্ন ভৌগোলিক বিষয়গুলি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পার্থক্যকরণের পরিবর্তে পরিসংখ্যান ভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া। (২) ভৌগোলিক উপাদানগুলির দৈশিক বিন্যাস সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া। (৩) ভূগোলে বিভিন্ন বিষয়ের বিশ্লেষণের জন্য তত্ত্ব, সূত্র ও মডেলের উপস্থাপন। (৪) বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যাবলীর জন্য আদর্শ অবস্থান অনুসন্ধান।
(৫) বস্তুগত সম্পদ সঠিক ব্যবহারের জন্য তত্ত্ব, সূত্র ও মডেল তৈরি। 

সংজ্ঞাঃ- ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে পাশ্চাত্যের ভৌগোলিকদের দ্বারা ভূগোল তত্ত্বসমূহকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে যে গাণিতিক ও পরিসংখ্যান ভিত্তিক মডেলের প্রয়োগ শুরু হয়, তাকে রাশিমাত্রিক বিপ্লব বলে। আবার, ইয়ান বার্টনের মতে, ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে ভূগোলে প্রচুর পরিমাণে রাশিতথ্য সংগ্রহ, সংগৃহীত ওই রাশিতথ্যের রাশিবিজ্ঞান ভিত্তিক ও গাণিতিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি সমূহের প্রয়োগের দ্বারা ভূগোলে যে দ্রুত রূপান্তর ঘটে, তা রাশিমাত্রিক বিপ্লব নামে পরিচিত। ১৯৬৩ সালে ইয়ান বার্টন (Ian Burton) সর্বপ্রথম 'রাশিমাত্রিক বিপ্লব' (Quantitative Revolution) শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। 

বৈশিষ্ট্যঃ- রাশিমাত্রিক বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল -- (১) ভূগোলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিমাণগত তথ্যের ব্যাপক ব্যবহার। (২) রাশিতথ্যকে বিশ্লেষণের জন্য নমুনা থেকে সমগ্র সম্পর্কে সম্ভাবনা তত্ত্বের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। (৩) ভূগোলের বিভিন্ন শাখাতে গণিতের ব্যবহার। (৪) জটিল বিষয়গুলিকে মডেল (মডেল হল বাস্তবের সরলীকৃত রূপ) দ্বারা সহজ সরল ভাবে উপস্থাপন। (৫) ভূগোলে দৈশিক বিশ্লেষণ নামে এক নতুন কর্মধারার সৃষ্টি। 

গুরুত্ব/তাৎপর্য্যঃ- রাশিমাত্রিক বিপ্লবের প্রধান গুরুত্ব/তাৎপর্য্যগুলি হল -- (১) অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য, খাদ্যসংকট, বেকারত্ব, পুনর্বাসন প্রভৃতি বিষয়ে মানব কল্যাণ (Human Welfare) সাধনে সাহায্য করে। (২) কোনো দেশের কৃষি, শিল্প, পরিবহণ, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ে জাতীয় পরিকল্পনা কর্মসূচী (National Planning Programme) রূপায়ণে সাহায্য করে। (৩) যেকোনো কর্মক্ষেত্রে কার্য পরিকল্পনা এবং নীতি নির্ধারণে সাহায্য করে। (৪) পরিসংখ্যানের মাধ্যমে কোনো বিষয়ের ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানা যায়। (৫) পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রশাসনিক কাজে স্বচ্ছতা আনতে ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হয়।

দৃষ্টিভঙ্গিঃ- ভূগোলে রাশিমাত্রিক বিপ্লবের প্রয়োগ দুটি প্রধান ধারণার প্রবর্তন করেছে। এক, স্থানিক বা দৈশিক বিশ্লেষণ (Spatial Analysis) এবং দুই, স্থানিক বা দৈশিক বিজ্ঞান (Spatial Science)। এই দুই ধারণার ভিত্তিতে ভূগোলে দৈশিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (Spatial Interaction) অর্থাৎ বিভিন্ন ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা বিশ্লেষণ এবং দৈশিক গঠন (Spatial Structure) অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন উপাদানের অবস্থানগত ধারণার ব্যাখ্যা আলোচিত হয়। 

তত্ত্ব ও মডেলঃ- রাশিমাত্রিক বিপ্লবের ওপর ভিত্তি করে ভূগোলে বিভিন্ন প্রকার তত্ত্ব ও মডেল গড়ে উঠেছে। রাশিমাত্রিক বিপ্লবের ওপর ভিত্তি করে রচিত কয়েকটি তত্ত্ব ও মডেল হল -- ভন থুনেনের ভূমি ব্যবহার সংক্রান্ত তত্ত্ব, ওয়েবারের শিল্প অবস্থানের ন্যূনতম ব্যয় তত্ত্ব, লশের শিল্প অবস্থানের সর্বাধিক মুনাফার তত্ত্ব, ক্রিস্টালারের কেন্দ্রীয় স্থান তত্ত্ব, গ্র্যাভিটি অ্যানালাইসিস মডেল প্রভৃতি।

উপযোগিতাঃ- (১) কোনো স্থানের গণনাক্ষম কোনো দ্রব্য বা বস্তুর সংখ্যা বোঝা যায়। (২) জনসংখ্যা বিষয়ক রীতিনীতি ও রুচিবোধ অনুসারে শহরের শ্রেণীবিভাগ করা যায়। (৩) মডেলের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ-এর পূর্বাভাষ দেওয়া সম্ভব হয়। (৪) একটি দেশ থেকে অপর একটি দেশের সামাজিক ব্যবধানের সীমারেখা জানা যায়। (৫) কোনো স্থানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও সংখ্যাগত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

সীমাবদ্ধতাঃ- (১) নীতিমূলক বিষয়গুলি গৃহীত না হওয়ার জন্য, কখনো কখনো রাশিমাত্রিক বিপ্লব ভৌগোলিক বাস্তবতাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনা। (২) আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যাতে বর্ণনামূলক পদ্ধতি কার্যকরী হলেও, রাশিমাত্রিক পদ্ধতি তা গুরুত্ব দেয় না। (৩) রাশিমাত্রিক পদ্ধতি ব্যবহারের সাফল্য অনেকাংশে ভৌগোলিক/গবেষকের গাণিতিক দক্ষতা-জ্ঞান, প্রাপ্ত তথ্যের পরিমাণ ও কম্পিউটারের ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। (৪) রাশিমাত্রিক বিপ্লবের অনেক মডেলই সময়ের সাথে সাথে অনুপযোগী হয়ে বর্তমানে অব্যবহার্য। (৫) রাশিমাত্রিক বিপ্লবের মতবাদগুলি দিয়ে ভূগোলের পরিপূর্ণতার দিক সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ পায়না।

1 comment:

Powered by Blogger.